মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:০৮ অপরাহ্ন

চ্যাম্পিয়নদের হারিয়ে বাংলাদেশের স্মরণীয় টেস্ট জয়

ক্রীড়া ডেস্ক : বাংলাদেশে সবে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। ঠিক সেই সময়টায় ১২ হাজার কিলোমিটার দূরে মাউন্ট মঙ্গানুইতে যা হলো, তাতে কেটে গেল বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাম্প্রতিক আঁধার। আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের চ্যাম্পিয়ন, দেশের মাঠে অপ্রতিরোধ্য দল, যাদেরকে তাদের মাঠে কখনোই কোনো সংস্করণে হারাতে পারেনি বাংলাদেশ, এতদিনের সেই অধরা ভুবন নিউ জিল্যান্ডে ধরা দিল বহুকাঙ্ক্ষিত এক স্বপ্নময় জয়।

মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্টে নিউ জিল্যান্ডকে ৮ উইকেটে হারিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে গেল দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে।

৫ উইকেটে ১৪৭ রান নিয়ে শেষ দিন শুরু করা কিউইদের ইনিংস শেষ করতে এক ঘণ্টাও লাগেনি বাংলাদেশের। এরপর ৪০ রানের ছোট্ট লক্ষ্য তাড়ায় দুটি উইকেট হারাতে হয় বটে, জয়ের মাহাত্ম্য তাতে কমছে না একটুও।

গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে দুঃসময়ের চক্রে ছিল বাংলাদেশ। মাঠের ভেতরে-বাইরে নানা বিতর্ক ও ঘটনাপ্রবাহে দল ও দেশের ক্রিকেট ছিল বিপর্যস্ত। বিশ্বকাপের পরও দেশে ফিরে পাকিস্তানের কাছে নাস্তানাবুদ হতে হয় বাজেভাবে। এই সফরে দল পায়নি চোট পাওয়া তামিম ইকবাল ও ছুটিতে যাওয়া সাকিব আল হাসানকে। সেই দলটিই দুঃস্বপ্নের প্রহর শেষ করে আদায় করে নিল ঐতিহাসিক জয়।

আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের গত চক্রে ৭ ম্যাচের ৬টিতেই হেরেছিল বাংলাদেশ, বাকিটি হয়েছিল ড্র। শুরুটা পাকিস্তানের বিপক্ষে হয়েছে যাচ্ছেতাই। অবশেষে অভিজাত সংস্করণের আসরে প্রথম জয়টি ধরা দিল।

নিউ জিল্যান্ডে প্রথম জয়ের অপেক্ষাটা ছিল আরও দীর্ঘদিনের। কিউইদের বিপক্ষে তাদের মাঠে তিন সংস্করণ মিলিয়ে ৩৩ ম্যাচ খেলে অবশেষে দেখা মিলল প্রথম জয়ের।

সেই জয় এলো এমন এক সংস্করণে, যা ছিল সবচেয়ে অভাবনীয়। সফরকারী দলগুলির জন্য নিউ জিল্যান্ডে টেস্ট জয়ের চেয়ে কঠিন কাজ যে এখন কমই আছে ক্রিকেট বিশ্বে!

দেশের মাঠে নিউ জিল্যান্ডের টানা ১৭ টেস্টের অপরাজেয় যাত্রা থামল এই হারে। সবশেষ তিন সিরিজে তারা হোয়াইটওয়াশ করেছিল পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ভারতকে। উপমহাদেশের কোনো দলের সবশেষ জয় ছিল ১১ বছর আগে, পাকিস্তানের। সেই দলকেই এবার বড় ব্যবধানে হারাল বাংলাদেশ।

চতুর্থ দিনে অসাধারণ বোলিংয়ে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া ইবাদত হোসেন চৌধুরি শেষ দিনেরও নায়ক। আগের দিনের চারটির সঙ্গে যোগ করেন তিনি আরও দুই উইকেট। সবমিলিয়ে ৪৬ রানে তার শিকার ৬ উইকেট।

দেশের বাইরে টেস্টে বাংলাদেশের কোনো পেসারের সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড এটি। তার হাত ধরে প্রায় ৯ বছর ও ৪৭ ম্যাচ পর টেস্টে ৫ উইকেট পেলেন বাংলাদেশের কোনো পেসার।

এরপর দুটি উইকেট নেন তাসকিন আহমেদ, শেষটি মেহেদী হাসান মিরাজ। ফিল্ডিং শেষ দিনও ছিল দুর্দান্ত। দারুণ দুটি ক্যাচ নেন শরিফুল ইসলাম ও বদলি ফিল্ডার তাইজুল ইসলাম। আগের দিনের রানের সঙ্গে নিউ জিল্যান্ড যোগ করতে পারে কেবল আর ২২ রান।

সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত উইকেটই সবার আগে নিয়ে নেয় বাংলাদেশ। শেষ দিনে সবচেয়ে বড় বাধা হতে পারতেন রস টেইলর। ১১১ টেস্টের অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানকে দিনের দ্বিতীয় ওভার আর নিজের দ্বিতীয় বলেই বিদায় করে দেন ইবাদত।

ভেতরে ঢোকা বল টেইলের ব্যাটে হালকা ছুঁয়ে উড়িয়ে দেয় বেলস। ৩৭ রানে দিন শুরু করা ব্যাটসম্যান আউট আর ৩ রান যোগ করেই। ইবাদত পূর্ণ করেন ৫ উইকেট।

পরের ওভারেই তিনি উইকেট পেয়ে যান আরেকটি। এটি অবশ্য খুব ভালো কোনো ডেলিভারি ছিল না, তবে উইকেট আসে অসাধারণ এক ক্যাচে। লেগ স্টাস্পে থাকা ডেলিভারি ফ্লিক করেন কাইল জেমিসন, মিড উইকেটে গোটা শরীর শূন্যে ভাসিয়ে দুর্দান্ত ক্ষীপ্রতায় বল মুঠোবন্দি করেন শরিফুল ইসলাম।

এরপর তাসকিন আহমেদের পালা। শেষ স্বীকৃত ব্যাটসম্যান রাচিন রবীন্দ্রকে বিদায় করে দেন তিনি দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে। রাউন্ড দা উইকেটে করা ডেলিভারি ড্রাইভিং লেংথে পিচ করে সুইং করে বেয়ে যায় খানিকটা। রবীন্দ্রর (১৬) ব্যাটের কানা ছুঁয়ে তা আশ্রয় নেয় কিপার লিটনের গ্লাভসে।

শেষ দিকে দ্রত কিছু রান তুলতে পারতেন যিনি, সেই টিম সাউদিকে শূন্য রানেই ফেরান তাসকিন। ফুলটস ডেলিভারি শেষ মুহূর্তে রিভার্স করে ভেতরে ঢুকে ছোবল দেয় স্টাম্পে।

শেষ ব্যাটসম্যান ট্রেন্ট বোল্ট দুটি চার মারার পর মিরাজকে চেষ্টা করেন ছক্কায় ওড়াতে। সীমানায় দুর্দান্ত কোচ নেন তাইজুল। মূল কাজ শেষ করে উল্লাস আর উদযাপনে মাঠ ছাড়ে বাংলাদেশ।

সেই উচ্ছ্বাস আরও বাড়ে জয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে। আঙুলে চোট পাওয়া মাহমুদুল হাসান জয় ব্যাট করতে পারেনি। ওপেন করতে নামা সাদমান ইসলাম ও নাজমুল হোসেন শান্ত আউট হন জয়ের পথে। তাতে স্রেফ একটু দীর্ঘায়িত হয় অপেক্ষা।

শেষ পর্যন্ত মুশফিকুর রহিমের বাউন্ডারিতে ধরা দেয় জয়। উইকেটে তখন তার সঙ্গী অধিনায়ক মুমিনুল হক।

বাংলাদেশের সফলতম টেস্ট অধিনায়ক ও এখনকার টেস্ট অধিনায়ক মাঠ ছাড়েন অসাধারণ জয়ের গৌরব নিয়ে। মাঠের বাইরে তখন চলছে দলের অন্য সবার উদযাপন। মাঠে থাকা কিছু বাংলাদেশি সমর্থক গর্জন করে চলেছেন দেশের নাম ধরে। আর ধারাভাষ্য কক্ষে ব্রেন্ডন ম্যাককালামের উচ্চারণ, “বিশ্ব ক্রিকেটকেও একটা বার্তা দিল বাংলাদেশ।”

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

নিউ জিল্যান্ড ১ম ইনিংস: ৩২৮

বাংলাদেশ ১ম ইনিংস: ৪৫৮

নিউ জিল্যান্ড ২য় ইনিংস: (আগের দিন ১৪৭/৫) ৭৩.৪ ওভারে ১৬৯ (টেইলর ৪০, রবীন্দ্র ১৬, জেমিসন ০, সাউদি ০, ওয়্যাগনার ০*, বোল্ট ৯*: তাসকিন ১৪-৩-৩৬-৩, শরিফুল ১২-২-৩০-০, মিরাজ ২২-৫-৪৩-০, ইবাদত ২১-৬-৪৬-৬, মুমিনুল ৪-০-৭-০)

বাংলাদেশ ২য় ইনিংস: (লক্ষ্য ৪০) ১৬.৫ ওভারে ৪২/২ (সাদমান ৩, শান্ত ১৭, মুমিনুল ১৩*, মুশফিক ৫*; বোল্ট ৫-৩-৪-০, সাউদি ৫-২-২১-১, জেমিসন ৩.৫-১-১২-১, ওয়্যাগনার ৩-১-৪-০)

ফল: বাংলাদেশ ৮ উইকেটে জয়ী

সিরিজ: ২ ম্যাচ সিরিজে বাংলাদেশ ১-০তে এগিয়ে

ম্যান অব দা ম্যাচ: ইবাদত হোসেন চৌধুরি

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

.coxsbazartimes.com

Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themesbcox1716222888